শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গৌ জয়তঃ



প্রেম-কলহ বনাম গুর্ব্ববজ্ঞা

একান্নবর্ত্তী পরিবার:
  একান্নবর্ত্তী পরিবার সচরাচর আর বিশেষ একটা দেখা যায় না, বা বলা ভাল - খুবই কম দেখা যায়। যেখানে পিতামহ-পিতামহী, পিতা-মাতা-কাকা-জ্যেঠা (পিতৃব্য), পিসিমা, পুত্র-কন্যা, ভ্রাতুষ্পুত্র-ভ্রাতুষ্পুত্রী-আদি পরিবারের অনেক সদস্য একসঙ্গে বাস করেন। সম্পর্কের উল্লেখ মাত্রেই আমরা বুঝতে পারছি - এই ধরনের পরিবারে বিভিন্ন স্তরের সম্পর্ক একসঙ্গে সমাবিষ্ট হয়।

  পরিবারের সভ্যগণ তাঁদের মধ্যে হৃদ্যতার বন্ধনে একত্র অবস্থান করেন। সন্তান-স্থানীয় সকলে পিতা-পিতৃব্যদের শ্রদ্ধা করেন। পিতৃ-স্থানীয় গণ পুত্র-কন্যা-ভ্রাতুষ্পুত্র-ভ্রাতুষ্পুত্রীদের স্নেহ করেন।

পিতা-পিতৃব্য:
  একান্নবর্ত্তী পরিবারে যেমন সম্প্রীতি এবং ঐক্যতান বিরাজ করে, তেমনি কদাচিৎ আপাত বিরোধও উপস্থিত হয়। অভিভাবক শ্রেণীর পিতা-পিতৃব্যগণ নিজ-নিজ প্রচেষ্টার দ্বারা পারিবারিক সমৃদ্ধি অর্জন করেন। সেই মহদুদ্যোগে আপন-আপন বুদ্ধি ও চিন্তা-প্রসূত মতের গড়মিল স্বাভাবিক। ফলতঃ উদ্দেশ্য একই হওয়া সত্বেও, আপাত-বিরোধ উপস্থিত হয়। তখন তাঁরা পিতামহাদির উপদেশ-আদেশের অনুসরণ করে বিভিন্ন মতের সংশ্লেষ দ্বারা পুনরায় ঐক্যমত্যে উপনীত হন।

পরবর্তী প্রজন্ম - পুত্র-কন্যা-ভ্রাতুষ্পুত্র:
  এইবিষয়ে পরবর্তী প্রজন্মের পুত্র-কন্যাগণ কিন্তু পিতার প্রতি বিরোধ লক্ষ্য করে, পিতার পক্ষ নিয়ে, কাকা-জ্যেঠার প্রতি শত্রুভাব-পোষণ বা কোনরূপ অবমাননা করেন না।। পুত্র-স্থানীয় সদস্যগণ পিতা ও পিতৃব্যকে সর্বপ্রকার পরিস্থিতিতেই, নিত্য-প্রণামাদি মুদ্রা দ্বারা আন্তরিক সম্মান প্রদর্শন করেন।

পরবর্তী প্রজন্মের ভ্রান্তি ও স্খলন:
  যদি পুত্র-স্থানীয় সদস্যগণ পিতা-পিতৃব্যের সম্পর্ক বুঝতে না পেরে পিতার পক্ষ নিয়ে পিতৃব্যের অবমাননা করেন, তবে তা পিতার চরণেই অপরাধ বিস্তার করে। সুশিক্ষিত পরিবার সেইরূপ অপরাধী পুত্রদের শাসন এবং প্রয়োজনে বহিষ্কার করে থাকে।

অপ্রাকৃত পরিবার:
  শুদ্ধভক্তিময় পরম্পরাতে অপ্রাকৃত পরিবার-বিন্যাস লক্ষিত হয়। অপ্রাকৃত পরিবারে অপ্রাকৃত প্রজন্ম বর্তমান। সেই বিবিধ স্তরের প্রজন্মকে আমরা প্রায়শই শ্রীচৈতন্য-আম্নায় সংখ্যা-বিশেষণে বিশেষিত অধস্তন হিসাবে বর্ণনা করি। যেমন শ্রীব্রহ্ম-মাধ্ব-গৌড়ীয় সম্প্রদায়ে প্রভুপাদ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর নবম অধস্তন আচার্য্যপ্রবর। তাঁর অনুকম্পিতগণ দশম অধস্তন আচার্য্য। প্রভুপাদ শ্রীল সরস্বতী ঠাকুরের প্রশিষ্যগণ একাদশ অধস্তন। ইত্যাদি।

প্রভুপাদ শ্রীল সরস্বতী ঠাকুরের সমাধি মন্দিরে নবম-অধস্তন-উল্লিখিত নাম-পরিচয়-ফলক
প্রভুপাদ শ্রীল সরস্বতী ঠাকুরের সমাধি মন্দিরে নবম-অধস্তন-উল্লিখিত নাম-পরিচয়-ফলক

অন্তঃ-প্রজন্মে আপাত বিরোধ - প্রেমপর সেবা:
  এই অপ্রাকৃত পরিবারেও আপাত দৃষ্টিতে সমপর্য্যায়ের (একই অধস্তন) আচার্য্যগণের আপাত বিরোধ লক্ষিত হয়। যেমন প্রভুপাদ শ্রীল সরস্বতী ঠাকুরের আশ্রিত কোন কোন দশম অধস্তন আচার্য্য অপর দশম অধস্তন আচার্য্যগণের সঙ্গে সেবা-প্রচারাদির পদ্ধতিগত কোন কোন বিষয়ে সহমত পোষণ করেন নাই। তাঁরা স্বীয় অপ্রাকৃত ভাব অনুসারে আপন পদ্ধতিতে বিশ্রম্ভ গুরুসেবা করেছেন। একই প্রজন্মের (দশম অধস্তন) আচার্য্যগণের এই সহমতের বাহ্যত অভাবকে আমরা জড়-চক্ষে বিরোধ বা কলহ হিসাবে দেখার ভুল করি। প্রকৃত প্রস্তাবে এই সিদ্ধ মহাত্মাগণের আপাত-বিরোধ কোন প্রাকৃত জড়-জাগতিক কলহ বা দ্বন্দ্ব নয়। সেই দশম অধস্তন পরম ভাগবতগণের সর্বপ্রকার সেবা ও সেবা-পদ্ধতিই প্রভুপাদ শ্রীল সরস্বতী ঠাকুরের প্রতি বিশেষ সেবা-বৈচিত্র্যের অংশ বিশেষ ।

  প্রভুপাদ শ্রীল সরস্বতী ঠাকুর স্বয়ং এই বিষয়ে লিখেছেন - “সকলেরই একই উদ্দেশ্য ও একই সেবাস্বার্থ থাকিলে কোনও প্রকার বিরোধের সম্ভাবনা হয় না। সেখানে আপাতবিরোধও প্রেমপর সেবার উৎকর্ষ-সাধনেই পর্য্যবসিত হয়।” (পত্রাবলী - শ্রীগৌড়ীয়মঠ, কলিকাতা - ৯ই অক্টোবর, ১৯৩১)

প্রভুপাদ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
প্রভুপাদ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর

সিদ্ধের প্রেমকলহ ও সাধকের প্রতি সতর্কীকরণ:
  শ্রীচৈতন্যভাগবত-রচয়িতা শ্রীমতীনারায়ণী-নন্দন ব্যাসাবতার শ্রীল বৃন্দাবন দাস ঠাকুর মহাশয় এই প্রকার আপাত-বিরোধময় সেবা-বৈচিত্র্য কে “প্রেম-কলহ” হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সেই সঙ্গে এই অপ্রাকৃত প্রেম-কলহ সম্বন্ধে প্রাকৃত-দৃষ্টিময় ভেদ-দর্শন-জনিত সাধু-নিন্দার অপরাধ-অগ্নিতে ভস্মীভূত হওয়ার সাবধান বাণী শুনিয়েছেন।

হেন প্রেম-কলহের মর্ম্ম না জানিয়া।
একে নিন্দে, আরে বন্দে, সে মরে পুড়িয়া॥

শ্রীচৈতন্যভাগবত মধ্য/২৪/৯৭

বৈষ্ণব-অপরাধী-গুর্ব্ববজ্ঞাকারী - ‘সে মরে পুড়িয়া’:
  দুর্ভাগ্যবশতঃ দশম অধস্তন বৈষ্ণব আচার্য্যগণের মধ্যে আপাত বিরোধ কে প্রেমপর সেবা-বৈচিত্র্য হিসাবে অনেকেই বুঝতে পারেন না। অনুগবর্তী শিষ্য-স্থানীয় একাদশ প্রজন্মের কেউ কেউ দশমের অর্থাৎ অভিন্ন শ্রীগুরুবিগ্রহগণের প্রতি বিরোধ প্রদর্শন করেন। পূর্ববর্ত্তী প্রজন্মের প্রতি এই বিরোধ একাদশের প্রতিষ্ঠাকামী-মৎসরতা-দোষ ছাড়া আর কী হতে পারে? দশম অধস্তন অভিন্ন শ্রীগুরুমূর্তির প্রতি তদধীন শিষ্য-তুল্য একাদশের অবজ্ঞা-উপেক্ষা-মাৎসর্য্য কেবল বৈষ্ণব অপরাধ নয়, এইটি গুর্ব্ববজ্ঞা-রূপ ভয়ঙ্করতম মহা-অপরাধ। একদিকে অন্তঃঅধস্তনের (সম-পর্য্যায়ের) প্রেমপর সেবা-উৎকর্ষ; আর অপর দিকে পরবর্ত্তী প্রজন্ম একাদশ অধস্তনের গুর্ব্ববজ্ঞারূপ মহা-অপরাধ - সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর ঘটনা। এই দুই বস্তুকে মুড়ি-মুড়কির ন্যায় একই ভাবার অবিচার বৈষ্ণবধর্মে কু-সিদ্ধান্ত বলে উল্লিখিত হয়।

আত্মনিবেদন ও শ্রীগুরুসেবা - কল্যাণের পথ:
  একাদশ অধস্তন তাঁদের অভিন্ন শ্রীগুরুপাদপদ্ম দশম অধস্তন আচার্য্যগণের শ্রীচরণ সেবা করবেন, দশমের মহিমা কীর্তন করবেন, সম্পূর্ণরূপে আত্নসমর্পণ করবেন - এইটাই ভক্তিদেবীর শ্রীচরণাশ্রিতগণের চিরাচরিত ও পরম্পরাগত ব্যবহার। শ্রীল প্রভুপাদের শ্রীচরণাশ্রিত মহাজনদের শ্রীল প্রভুপাদের পার্ষদ বা প্রভুপাদের গণ বলা হয়। তাঁরা শ্রীল প্রভুপাদের কৃপাভাজন, প্রিয় এবং অত্যন্ত স্নেহের পাত্র। শ্রীল প্রভুপাদের গণ আমাদের অভিভাবক, পরমাত্মীয় এবং সকলেই পরম করুণাময়। কায়মনোবাক্যে তাঁদের সেবাই আমাদের পরম​ ধর্ম। শ্রীল প্রভুপাদের সেই গণ সকলকে আমরা সম্মান করব, ভালবাসব, হৃদয়ের সুতল-অন্তঃস্থল থেকে প্রীতি দ্বারা পূজা করব - এই আশা। এর দ্বারাই আমরা দশম অধস্তন আচার্য্যগণের কৃপা প্রাপ্ত হতে পারি।

সগণ শ্রীল প্রভুপাদের বিশেষ সেবা ও কৃপাকর্ষণ:
  বদ্ধ জীবের বসতিস্থল এই মায়িক জগত। দুর্ভাগ্যবশতঃ এই জগতে বর্তমানে প্রভুপাদের গণের প্রতি চরম অবমাননা ঘটে চলেছে। আমাদের পরম-কারুণিক শ্রীগুরুপাদপদ্মগণের প্রতি এই অসম্মান-প্রদর্শন আমাদের হৃদয় বিদারণের কারণ। যেখানেই শ্রীল প্রভুপাদের গণের শ্রীচরণে সামান্যতম অপরাধের আভাসও দেখব, সেখানেই তারঃস্বরে প্রতিবাদ-রূপ বিশেষ সেবা শ্রীগৌড়ীয়-আশ্রিত সকলেরই কর্তব্য। গুর্ব্ববজ্ঞারূপ অপরাধের প্রতিবাদই প্রকৃত তৃণাদপি সুনীচতা। সেই সেবা দ্বারাই আমরা শ্রীল প্রভুপাদের প্রকৃত কৃপা প্রাপ্ত হতে পারব। মূলগুরু শ্রীনিত্যানন্দ-পার্ষদ শ্রীমীনকেতন রামদাসের প্রতি অবমানা হলে শ্রীল কবিরাজ গোস্বামীপাদ নিজ-ভাই কে ভর্ৎসনা করেছিলেন। তৎফল-স্বরূপ শ্রীমন্নিত্যানন্দ প্রভু শ্রীল কবিরাজ গোস্বামীপাদের প্রতি প্রসন্ন হয়ে তাঁকে সর্বস্ব প্রদান করেছিলেন।

ভাইকে ভর্ৎসিনু মুঞি, লঞা এই গুণ।
সেই রাত্রে প্রভু মোরে দিলা দরশন॥

শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত আদি/৫/১৮০

মাৎসর্য্য - বঞ্চনার পথ:
  কাম-আদি ষড়রিপুর মধ্যে প্রথম পাঁচটি রিপুকেই শ্রীহরিসেবায় নিযুক্ত করা যায়। যথা - “কাম কৃষ্ণকর্মার্পণে”, “ক্রোধ ভক্তদ্বেষীজনে” ইত্যাদি। কেবল ষষ্ঠ রিপু মৎসরতাকে কোনও ভাবে সাধনায় নিয়োজিত করা যায় না। মাৎসর্য্য সম্পূর্ণরূপে বর্জ্জন করার প্রয়োজন হয়। শিষ্য-প্রশিষ্য স্তরের কেউ পূর্ববর্ত্তি আচার্য্যের অবমাননা করলে তার কারণ সেই ব্যক্তির মাৎসর্য্য ও প্রতিষ্ঠাশা। মাৎসর্য্য-পরায়ণ ব্যক্তি - তিনি যে আশ্রমে - বা যে বর্ণে - বা যে আসনে - অথবা যে অপ্রকৃত-ব্রুব-সম্বন্ধেই অবস্থান করুন না কেন, তাঁকে সর্বতোভাবে পরিত্যাগ না করলে, তৎসঙ্গকারী সকলেই শ্রীহরিভজন-সাধন থেকে বঞ্চিত হবেন।

  অবৈষ্ণব পরিবারেও, সুকর্মিগণ পিতৃব্যের প্রতি কোনও রূপ অবমাননা বা অমর্য্যাদা করেন না। সুশিক্ষিত পুত্র-ভ্রাতুষ্পুত্রগণ পিতা ও পিতৃব্যগণকে সমভাবে সম্মান করে থাকেন। কুকর্মী ও আধ্যক্ষিকের বিচার কিন্তু সম্পূর্ণ পৃথক! ইতিহাসে কি দেখেন নাই, আওরঙ্গজেব স্বীয় প্রতিষ্ঠাশা চরিতার্থ করতে পিতা শাহজান কে বন্দী তথা উপযুক্ত জ্যেষ্ঠভ্রাতা সহ অন্যান্য সহোদরদের হত্যা অথবা বিতাড়িত করে সম্রাট পদ - দিল্লির মসনদ অধিকার করেছিলেন!

উদ্দেশ্য:
  এই ক্ষণস্থায়ী তথা দুর্লভ মনুষ্য জীবনে শ্রীহরিভজনই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এখন সাধককেই স্থির করতে হবে - সেই লক্ষ্যে সময়ের অপচয় না করে, অর্থাৎ এই মুহূর্তেই, পুতনারূপী গুরুব্রুবদের পরিত্যাগ করব? কিংবা, লোকাপেক্ষার বশবর্ত্তী হয়ে অথবা ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা-ভোগ-সুবিধাদির জন্য আপোষ করে, বৈষ্ণব-অপরাধ ও গুর্ব্ববজ্ঞা-রূপ অপরাধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে অংশ গ্রহণ করব?

জয়োৎকর্ষ:
  জগদ্গুরু প্রভুপাদ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর জয়যুক্ত হৌন।
  শ্রীল প্রভুপাদের পার্ষদ, তৎ-প্রকাশ-মূর্ত্তি, দশম-অধস্তন আচার্য্যবৃন্দ জয়যুক্ত হৌন, জয়যুক্ত হৌন।

More