শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গৌ জয়তঃ



হে যোগমায়া দেবি!


(১)
দেবী যোগমায়া     শুদ্ধা-ভক্তি কায়া
প্রণমি রাঙা-চরণে ।
মাগো,
শুন’ দুটি কথা     হৃদয়ের ব্যথা
জ্বলি’ গো মুঁই পরাণে ॥

(২)
স্মিতহাস্য-রাশি     তব​-ক্রোড়ে আসি
শিশু এক চন্দ্রভানু ।
গাত্রের বরণে     শ্রীকৃষ্ণ-স্মরণে
রাখে পিতা নাম – ‘কানু’ ॥

(৩)
কৃষ্ণ​কথা-সুখে     শুনি’ মাতৃ-মুখে
শিশু-চিত্ত হরষিত ।
“তব পুত্র মুঁই     শুদ্ধ ভক্ত হই’
কৃপা করি, কর হিত॥”

(৪)
পালিয়া-যতনে     অকার্পণ্য-মনে
সুপুত্র তব অনন্য ।
বিদ্যা-শিক্ষা দিয়া     সুযোগ্য-গড়িয়া
চিকিৎসক-কানু ধন্য ॥

(৫)
সে পুষ্প-তরুণ     তুমি, মা করুণ
অর্পিলে গুরুচরণে ।
সরস্বতী-পুত্র​     ‘বৈদ্য’ সেবা-ব্রত
গুরু-আদেশ পালনে ॥

(৬)
স্বভজনাবাসে     কৃষ্ণকান্তি দাসে
সরস্বতী দিলা স্থান ।
‘ভকতি কুসুম’     উপাধি-ভূষণ
​​ নির্দেশিলা যাঁর নাম ॥

(৭)
শ্রমণ​-চরণে     প্রতিষ্ঠা-দর্শনে
যার মনে মাৎসর্য্য​ ।
প্রতিষ্ঠাশা-কামী     অন্তরে – ভণ্ডামি
সে সঙ্গ – কুসঙ্গ, বর্জ্য ॥

(৮)
শ্রীব্রজপত্তনে     সরস্বতী-গণে
যেই করে নিন্দা-মন্দ ।
বৈষ্ণব​-ধরমে     বিচ্যুত-করমে
কলিহত সে পাষণ্ড ॥

(৯)
মাতা ঠাকুরণি,     মোরে হীন জানি,
স্বগুণে ক্ষম’ আপনি ।
বিরহে-প্রকটে     কভু নিষ্কপটে
না সেবিনু কানুমণি ॥

ওঁবিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তি কুসুম শ্রমণ গোস্বামী মহারাজ আকর মঠরাজ শ্রীচৈতন্যমঠের দশম অধস্তন আচার্য্যরত্ন। তিনি প্রভুপাদ শ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুরের প্রিয়তম শিষ্য​। শ্রীল শ্রমণ গোস্বামীপাদ শ্রীমতী যোগমায়াদেবীর পুত্র রূপে জগতে আবির্ভূত হন​।

এই প্রার্থনা-পত্রটি শ্রীমতী যোগমায়াদেবীর শ্রীচরণে কোন এক দীনের বিজ্ঞপ্তি।

হে শ্রীমতী যোগমায়াদেবি, আপনি শুদ্ধাভক্তি-রূপিণী, আমি আপনার শ্রীচরণে প্রণতি জানাই। হে মাতা ঠাকুরাণি, আমি অতি অধম ও দুঃখী, আপনার শ্রীচরণান্তিকে হৃদয়ের তাপ নিবেদন করতে চাই। (১)

হে মাতঃ ৪১৫ শ্রীগৌরাব্দে (১৯০০ খৃষ্টাব্দে) তোমার অপ্রাকৃত কোল আলোকিত করি স্মিতহাস্যে সুশোভিত এক দিব্য শিশুপুত্র আবির্ভূত হন। মুখকমলে স্নিগ্ধ চন্দ্রকিরণ​। পুত্রের গাত্রের বর্ণ শ্রীনন্দনন্দনের স্মৃতি উদ্রেক​ করে​। সেইজন্য পিতা শ্রীদুর্গাচরণ প্রভু নাম রাখেন শ্রীকৃষ্ণকুমার, ডাকনাম ‘কানু’। (২)

মা, তোমার শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণের সহায়তা-কল্পে গৃহকর্ম সম্পাদন​-কারী সেই পুত্র তোমার নিকট শ্রুত বিষয় জিজ্ঞাসা করতেন​। একদিন তুমি জিজ্ঞাসিতা হয়ে উত্তর করলে, বংশে একজন যথাযথ​ বৈষ্ণব হলে পূর্বের একবিংশ​ প্রজন্ম​ বৈকুণ্ঠে উদ্ধার লাভ করেন। শিশুপুত্র শ্রীকৃষ্ণকুমার ত​ৎক্ষণাৎ তোমার শ্রীচরণে প্রণাম করে বলল - “মা, আশীর্বাদ কর যেন শুদ্ধ ভক্ত হতে পারি।” (৩)

তুমি পুত্র শ্রীকৃষ্ণকুমার কে যত্ন-সহকারে উত্তম রূপে পালন করে বিদ্যা-শিক্ষা-আদি প্রদান করলে। শ্রীকৃষ্ণকুমার ব্রিটিশ আমলে ঢাকা মিটফোর্ড মহাবিদ্যালয় থেকে ডাক্তারী পাশ করে​ সুযোগ্য চিকিৎসক রূপে প্রতিষ্ঠিত হল​। (৪)

হে যোগমায়া দেবি, সেই তরুণ পুত্র কে তুমি শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুরের শ্রীচরণে, শ্রীগুরু গৌরাঙ্গের সেবার্থ কুসুমিত পুষ্প রূপে অঞ্জলী প্রদান করলে। গুরুদেব প্রভুপাদ শ্রীল সরস্বতী ঠাকুর তাঁকে এক আসনে পাঞ্চরাত্রিক দীক্ষামন্ত্র ও শ্রীহরিনাম প্রদান করে নাম দিলেন শ্রীকৃষ্ণকান্তি ব্রহ্মচারী। শ্রীগৌরসরস্বতী প্রশ্ন করলেন – “ডাক্তার বাবু, আমি আপনাকে দীক্ষা দিলাম​। এখন আপনি কী করবেন​?” শ্রীকৃষ্ণকান্তি ব্রহ্মচারী শ্রীল প্রভুপাদের শ্রীচরণে শরণাগত হয়ে শ্রীগুরুর আদেশে তৎকালে চিকিৎসকহীন (১৯২৭) শ্রীধাম মায়াপুরে চিকিৎসা দ্বারা ভক্তগণের সেবায় ব্রতী হলেন। (৫)

শ্রীগৌড়ীয় গোষ্ঠীপতি শ্রীশ্রীগৌরসরস্বতী

শ্রীগৌড়ীয় গোষ্ঠীপতি শ্রীশ্রীগৌরসরস্বতী প্রভুপাদ

হে জননি, তোমার শ্রীকৃষ্ণকান্তিকে শ্রীগৌরসরস্বতী স্ব​য়ং আকর মঠরাজ শ্রীচৈতন্য মঠে তাঁর শতকোটি-নামযজ্ঞ-অনুষ্ঠানের স্থল​ স্বীয়​ ভজন​-কুটীরে স্থান দিলেন​। শ্রীনবদ্বীপ ধাম প্রচারিণী সভায় ‘উপদেশক’ ও ‘ভক্তিকুসুম’ এই উপাধিদ্বয় দ্বারা শ্রীকৃষ্ণকান্তির ব্রজনবযুবদ্বন্দ্বের নিত্যলীলায় কুসুম-মঞ্জরী-নামা নিত্য ব্রজদেবী-পরিচয় প্রকাশ করলেন। (৬)

শ্রীল ভক্তিকুসুম শ্রমণ গোস্বামী মহারাজ

শ্রীল ভক্তিকুসুম শ্রমণ গোস্বামী মহারাজ

“বৈষ্ণবের পাছে, প্রতিষ্ঠাশা আছে, তা’ত কভু নহে অনিত্য বৈভব।” সুতরাং শ্রীভক্তিকুসুম শ্রমণ-শ্রীচরণে স্বাভাবিকী বৈষ্ণবী-প্রতিষ্ঠা দর্শন করে কোন কোন দুর্ভাগা তোমার কানুর প্রতি মৎসর হয়ে ওঠে। জ​ড়​-প্রতিষ্ঠা-কামী সেই সকল কলহ​-পরায়ণ ব্যক্তি বর্ণ​-আশ্রমের আবরণে প্রকৃতপক্ষে কলির গুপ্ত​চর​। বাহ্যে ব্রাহ্মণ-সন্ন্যাসী, কিন্তু অন্তরে “হরিজনদ্বেষ​, প্রতিষ্ঠাশাক্লেশ”-দগ্ধ​ ও ভণ্ডামিতে পরিপূর্ণ। হে যোগমায়াদেবি, তোমার অপার কৃপায় সেইসব দুঃসঙ্গ যেন সর্বতোভাবে বর্জন করতে পারি। “বৈষ্ণব চরিত্র​, সর্ব্বদা পবিত্র​, যেই নিন্দে হিংসা করি’ । ভকতি বিনোদ, না সম্ভাষে তারে, থাকে সদা মৌন ধরি ॥” (৭)

আচার্য্য শ্রীচন্দ্রশেখর ভবন তথা শ্রীব্রজপত্তন – গৌড়ীয় গোষ্ঠীপতি শ্রীগৌরসরস্বতী প্রভুপাদের ভজনাল​য়​। সেই আলয়ে স্ব​য়ং শ্রীচৈতন্যসরস্বতীর পুত্রের তথা তাঁর গণের নিন্দা-অবমাননা-রূপ অপকর্মকারী সকলেই ছন্ন​-বৈষ্ণববেশধারী, বৈষ্ণবত্ব হতে চ্যুত এবং প্রকৃত প্রস্তাবে কলিহত পাষণ্ড​। মায়াবাদ-রূপ কলিমল-ভোজন​-কারী মায়াবাদী - “মায়াবাদ-উপদেশ​, গৌরাঙ্গদাসের বেশ​, গ্রহণ করিয়া কলিরাজ।” (৮)

হে মাতা ঠাকুরাণি, আমি দীন হীন। হে মহাবৈষ্ণবি, স্বীয় অহৈতুকী করুণা দ্বারা আমার ন্যায় দুর্বল দাসাভাস কে ক্ষমা করো মা। প্রকট কালে মহাবৈষ্ণবচূড়ামণি শ্রীকৃষ্ণকান্তি অপ্রাকৃত আচার্য্যলীলায় যখন তৃণাদপি সুনীচ ও তরুসম সহিষ্ণু হয়ে শ্রীচৈতন্যসরস্বতীর সেবা-সম্পাদন করেছেন তখন এই মূর্খ তাঁর কোন সেবা করে নাই। বর্তমান কালেও সেই শ্রীগুরুপিতামণির অপ্রকটাবস্থায় তাঁর প্রতি সাক্ষাৎ অবমাননা লক্ষ্য করেও শ্রীনরোত্তম দাস ঠাকুরের আদেশ – “ক্রোধ ভক্তদ্বেষিজনে” – পালন করতে পারি নাই। (৯)

More